দেশ স্বাধীনের পর ‘আরও বেশি খাদ্য ফলান’ শ্লোগানে ‘সবুজ বিপ্লব’ এর ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এই ডাকে তিনি রেখেছেন সেনানায়কের ভূমিকা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলেও ‘সোনার বাংলাদেশ’ স্বপ্ন বাস্তবায়নে রণাঙ্গন থেকে ফিরে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে অগ্রজের ভূমিকা পালন করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। কেবল সড়ক, সেতু আর কালভার্ট নির্মাণই নয় ‘রাবার ড্যাম’ স্থাপন করে হাসি ফুটিয়েছেন কৃষকের মুখে।
তাঁর হাত ধরেই সূচিত হয় ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষকের গ্রোথ সেন্টার স্থাপনের কাজ। বঙ্গবন্ধু কন্যার ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ রূপকল্প বাস্তবায়নের ভিতটাও রচনা করে দিয়ে গেছেন তিনিই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ‘সমস্ত সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন।’
বঙ্গবন্ধুর এই অনুরোধ আমৃত্যু পালন করে যাওয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি। তিনি বিশ্ব ব্যাংকের ‘ম্যাজিক বয়’’ প্রৌকশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। সতীর্থ জামিলুর রেজা চৌধুরী যাকে বলতেন ‘ভিশনারি টেকনোক্র্যাট’।
তবে সাধারণ মানুষ তাকে চেনেন কেবল এলজিইডি’র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। কেননা প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাঁর নেতৃত্বেই সরকারের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবদান রেখেছে স্থানীয় সরকারের এই বিভাগটি।
তবে এলজিইডি কোন বিভাগের কাজ কেড়ে নেয়নি বরং দেখিয়েছে কিভাবে কাজের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা যায় যা স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভূত অবদান রাখতে পারে।
জনাব সিদ্দিক, বিশ্বাস করতেন আগামীর বিশ্ব হবে উদ্ভাবনীর । তাই তিনি দেশীয় ব্যয় সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। দেশের প্রথম বায়োগ্যস, উইন্ডমিল, প্রি-স্ট্রেস প্লান্ট, স্যান্ড রোলার, এছাড়া হালকা যানবাহন চলচলের জন্য গ্রামীন সড়কে তিনিই এএসেস প্রচলন করেন।
হাজা মজা পুকুর খনন, বিল-হাওড় সংরক্ষণ, পরিবেশ এবং প্রতিবেশ উন্নয়নের জন্য তিনি বনজ, ফলজ এবং পরিকল্পিত ভেষজ বাগান, কিংম্বা নার্সারি অফিস কমপাউন্ডে তৈরি করেন।
দেশের প্রথম ফ্লাইওভার, ধানমন্ডি লেককে বিশ্বমানের করা, হাতিরঝিল প্রকল্পের সূচনা, এএইচডিএম প্রযুক্তি, সড়ক নিরাপত্তা- এ সব বিষয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক।
বিশ্বকে হতবাক করে দিয়ে তিনিই প্রথম তৈরি করেন উপজেলা এবং ইউনিয়ন বুক, ডিজিটাইজড ম্যাপ, এম আই এস এবং জি আই এস আর রিমোট সেন্সিং।
তিনিই প্রথম সরকারি দপ্তরে বাধ্যতামূলকভাবে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু করেন। সরকারি সেবাকে সহজলভ্য করতে চালু করেন ডিজিটাল সেবা। ইউনিয়ন অফিস পর্যায়েও ফ্যাক্স-ই-মেইল যুক্ত করেন দাপ্তরিক কার্যক্রমে। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দিয়েছেন অংশীজনদের সেবা। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতেও তার অবদান প্রবাদতুল্য।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তার ঝুড়িতে যোগ হয় ভাসানী স্বর্ণপদক ,কবি জসীম উদ্দীন স্বর্ণপদক ,আইইবি স্বর্ণপদক, সিআর দাস স্বর্ণপদক, আব্বাস উদ্দীন স্বর্ণপদক, শেরেবাংলা স্বর্ণপদক, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী স্বর্ণপদক, বাংলা একাডেমি ফেলোসহ বহু পুরস্কার।
তবে এসব পুরস্কারের বিষয়ে পুরোপুরি নির্মোহ ছিলেন ব্যক্তি কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। কাজের মধ্যেই ডুবে থাকতেন দিনমান। মৃত্যুর ঘণ্টা খানেক আগেও যুক্তরাষ্ট্রে একমাত্র ছেলের বাসায় বসে মেইল করেন সম্প্রতি না ফেরার দেশে পাড়ি জমানো জামিলুর রেজা চৌধুরিকে। সেই মেইলে ছিলো ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নের রূপরেখা। মূলত তার রক্তে মিশেছিলো দেশ, দেশের মানুষ আর বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।
স্রষ্টার সঙ্গেও তাঁর সম্পর্কটা ছিলো একান্ত পর্যায়ের। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে অস্ফূট স্বরে তাঁকেই স্মরণ করেছেন বারবার।
২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ৬৩ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমান স্রষ্টার সান্নিধ্যে। রাষ্ট্রিয় সম্মাননা শেষে, লাল- সবুজের পতাকায় আবৃত হয়ে সওয়ার হয়েছেন অনন্ত যাত্রায়। এখন রাজধানীর বনানী কবরস্থানে ঘুমুচ্ছেন চির প্রশান্তিতে। অখণ্ড অবসরে।
এগ যুগ পেরিয়ে গেছে তিনি আমাদের মাঝে নেই। তারপরও তাঁর শুন্যতা দিন দিনই বাড়ছে। জোরালো হচ্ছে ‘বিশ্বব্যাংকের ম্যাজিক বয়’ খ্যাত এই কীর্তিমানের জাতীয় সম্মাননা প্রাপ্তির দাবি।